বিপ্লব সরকার, টাঙ্গাইল প্রতিনিধি
টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে আরেকটি নারীর আর্তনাদ তুলে ধরল সমাজের এক নির্মম বাস্তবতা— যৌতুক নামের ভয়াবহ এক সামাজিক অভিশাপ। অভিযোগ অনুযায়ী, ৩০ লক্ষ টাকা যৌতুক না দেওয়ায় স্বামী ও তার পরিবার মিলে তরুণ গৃহবধূ ফারহানা ফারিহা ওরফে কাজলকে শারীরিক ও মানসিকভাবে ভয়াবহভাবে নির্যাতন করে। তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে ব্ল্যাংক চেকে স্বাক্ষর নেয়া হয়, এমনকি নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পেও স্বাক্ষর আদায় করা হয়— যা নিছক অর্থনৈতিক শোষণই নয়, মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।
২২ বছর বয়সী ফারহানা বর্তমানে টাঙ্গাইল শহরের শাকিন রেজিস্ট্রি পাড়ায় একটি ভাড়া বাসায় মায়ের কাছে আশ্রয় নিয়েছেন। তার পৈতৃক নিবাস কালিহাতী উপজেলার কাছিনা লখাই, ডাকঘর নগরবাড়ি, জেলা টাঙ্গাইল। বাবার নাম আবুল কালাম আজাদ।
২০২৫ সালের ১৩ জুলাই রাত ১১টায় কালিহাতীর ভবানীপুর গ্রামে স্বামীর বাড়িতে ঘটনার সূত্রপাত। অভিযুক্ত ১ নম্বর আসামি শওকত হোসেন তালুকদার ওরফে ঠান্ডু (পিতা: জহিরুল তালুকদার), ২ নম্বর আসামি মমিন তালুকদার (পিতা: জহিরুল তালুকদার), ও ৩ নম্বর আসামি আকলিমা (স্বামী: মমিন তালুকদার)—তিনজন মিলে পরিকল্পিতভাবে ফারহানাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে। একপর্যায়ে প্রাণনাশের ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে তিনটি নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেয় এবং ব্ল্যাংক অবস্থায় চেক নম্বর MSW ৩৭৮২৩৩৬ ও ৩৭৮২৩৩৭ আত্মসাৎ করে।
সাংবাদিক সম্মেলনে ফারহানার চোখের জল মুছে বললেন:
"আমি শুধু একজন স্ত্রী নই, আমি একজন মানুষ। অথচ আমাকে বারবার টাকার কাছে বিক্রি করে দিতে চেয়েছে ওরা। আমি ন্যায়বিচার চাই, আমি আর কাউকে আমার মতো হতে দেখতে চাই না।"
তিনি আরও জানান, পুরো ঘটনাটি কালিহাতী থানায় লিখিত অভিযোগ আকারে দাখিল করা হয়েছে ২৭ জুলাই ২০২৫ তারিখে। মামলা হয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (২০০৩ সালের সংশোধনী) এর ১১(গ)/৩০ ধারায়। এছাড়া ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩৮৬ (চাঁদাবাজি), ৩৭৯ (চুরি), ৩২৩ (আঘাত/নির্যাতন) ও ৫০৬ (হুমকি প্রদান) ধারাতেও অভিযোগ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
এই ঘটনা নিছক একটি পারিবারিক কলহ নয়, এটি নারীর সম্মান, নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত। যেখানে একজন নারীকে টাকা না দেওয়ার অপরাধে নির্যাতিত হতে হয়, সেখানে প্রশ্ন উঠে আমাদের নৈতিকতার, আইন প্রয়োগের কার্যকারিতা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার।
যৌতুক বিরোধী আইন বাংলাদেশের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবুও সমাজের বহু স্তরে আজও এই কলঙ্কিত প্রথা নারীকে অবমূল্যায়ন করে, ভাঙনের মুখে ঠেলে দেয় একেকটি পরিবারকে।
এই প্রতিবেদন শুধু সংবাদ নয়—এটি একজন নারীর জীবন থেকে নেওয়া রক্তমাখা বাস্তবতা। আমরা চাই, প্রশাসন যথাযথ তদন্ত ও আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করুক। যেন এই সাহসী নারীর কান্না না হয় নিষ্ফল, যেন অন্য কেউ না হয় এমন নির্যাতনের শিকার।