লেখক:
সুলেখা আক্তার শান্তা
মন্টু ছিল পেশাদার চোর, তবে ছিঁচকে চোর। গরু-ছাগল চুরির মতো বড় কাজে সে কখনো হাত দিত না। সারাদিন প্রায় না খেয়েই কাটতো তার। রাতে সুবিধামতো কোন গৃহস্থের রান্নাঘরে ঢুকে পেট পুরে খেত। লোকমুখে শোনা কিছু মন্ত্র-তন্ত্র কাজে লাগিয়ে সে ঘুম না ভাঙানোর কৌশল প্রয়োগ করতো, যদিও এসবে তার বিশ্বাস ছিল না। এমন জীবন যাপন তার মোটেও পছন্দ ছিল না। মানুষ একটা পরিচয় নিয়ে সমাজে বাস করে। তার পরিচয় কী? চোর! এটা বলার মতো কোন কথা হলো। হ্যাঁ রে জীবন! তবে সে পেশায় একটা স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করত। যতটুকু দরকার, ততটুকু চুরি, কোনো উচ্চাকাঙ্খা নেই তার।
একদিন অন্ধকারে কাজ সেরে ফেরার পথে মন্টু রফিককে দেখতে পায়। রফিক এক টুকরো রুটি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, সেটাই হয়তো রাতের খাবার বউয়ের সঙ্গে ভাগাভাগি করে খাবে। চোখে-মুখে অবসাদ। মন্টু রফিককে চিনতো, এই এলাকায় নতুন আসা যুবক। গ্রাম থেকে পালিয়ে এসেছে প্রেমিকা রহিমাকে নিয়ে। পরিবারের লোক তাদের ভালোবাসা মেনে নেয়নি, তাই শহরে এসে রিকশা চালিয়ে চালাচ্ছিল জীবিকা কিন্তু রিকশা চালানোর কঠিন পরিশ্রম রফিকের সইছিল না।
"কাজ পাচ্ছ না?" মন্টু জিজ্ঞেস করে।
রফিক হতাশ কন্ঠে বলে, "এই জীবন নিয়ে আর পারছি না ভাই। রহিমাকে নিয়ে কীভাবে জীবন চালাবো?"
মন্টু একটু ভেবে বলল, "চুরি করতে পারবে?"
রফিক চমকে উঠে, "চুরি?"
হ্যাঁ, আমার তো আর কোন বিদ্যা জানা নাই। এটাই জানি, এটা দিয়ে তোমাকে সাহায্য করতে পারি। ছোটখাটো চুরি। বড় কিছু নয়, শুধু পেট চালানোর মতো।
রফিক প্রথমে রাজি হয়নি, কিন্তু রহিমার ক্ষুধার্ত চেহারা আর নিজের ব্যর্থতা তাকে মানাতে বাধ্য করে। মন্টু তাকে রান্নাঘরে ঢোকার কৌশল, লোকের ঘুম না ভাঙানোর নিয়ম শিখিয়ে দেয়। প্রথম কয়েকদিন সব ঠিকঠাক গেল। রফিক অল্প অল্প চুরি করে সংসার চালাতে লাগল। রহিমা তাকে বারণ করত, কিন্তু উপায়ও তো ছিল না অন্য কিছুর।
কথায় বলে গৃহস্থের একদিন…যথারীতি বিপদ এসে হাজির। এক গৃহস্থের বাড়িতে চুরি করতে গিয়ে রফিক ধরা পড়ে গেলো। মালিক ও তার ছেলেরা তাকে পিটিয়ে আধমরা করে দিলো। রক্তাক্ত অবস্থায় রফিক ফিরে এলো রহিমার কাছে। সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আর পারব না, এই জীবন আমি চাই না।
মন্টু সেই রাতে রফিককের শয্যাপাশে বসে ভাবছিল। সে প্রথমবার নিজের কাজ নিয়ে অনুশোচনা বোধ করল। রফিককে সে অসৎ পথে টেনে এনেছে, আর তাতে তার ক্ষতি হয়েছে। মন্টুর মনে পড়ল, সে নিজেও একদিন সাধারণ মানুষ ছিল, কিন্তু প্রয়োজনই তাকে চোর বানিয়েছে। মানুষ সৃষ্টি হলে তার বেঁচে থাকার জন্য কাজও সৃষ্টি হওয়া দরকার। না হলে এই বিরাট পৃথিবীতে অসহায় মানুষ নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবে কী করে? মন্টু মুখ ফিরিয়ে অনাগত অশ্রু লুকোতে চেষ্টা করে। রফিককের এই অবস্থা দেখে বুঝলাম, এই পথে কাউকে টেনে আনা উচিত নয়।
পরদিন মন্টু আর রফিক ও রহিমাকে ডেকে বলল, একটা কাজ জোগাড় করেছি। ছোটখাটো দোকানের কাজ, বেতন কম, এই দিয়ে চলবে সংসার।
রহিমা অবাক হয়ে তাকাল, স্বামী কে বলে "তুমি চুরি ছাড়বে?"
রফিক মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।
কয়েক মাস পর রফিক ও মন্টু একসাথে একটি ছোট রেস্তোরাঁর কাজ শুরু করে। রহিমাও সেলাইয়ের কাজ জুটিয়ে নেয়। আয় কম, কিন্তু মনের শান্তি আছে। রফিক একদিন মন্টুকে বলল, তুমি আমাদের নতুন জীবন দিয়েছ।
মন্টু হেসে বলল, না, তোমরাই আমাকে নতুন করে জীবন চালাতে শিখিয়েছ।